সাতক্ষীরা জেলায় ২৫৮টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন হয়নি
মিহিরুজ্জামান সাতক্ষীরাঃ
সাতক্ষীরা জেলার ৭টি উপজেলায় ২৫৮টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলমান রয়েছে। ছোট এই জেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত বিপুল পরিমান এসব স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান চলমান থাকলেও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে একটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। অর্থাৎ যে সমস্ত স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান চলমান রয়েছে তার সবই অবৈধ। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তালিকা করে জেলা প্রশাসনের দপ্তরে প্রেরণ করা হলেও ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়নি সংশ্লিষ্ট বিভাগ। ফলে বহালতবিয়াতে অবৈধ এসব স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান চলমান থাকায় সরকার অন্তত কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছেন,সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের সংখ্যা বর্তমানে ১০৯টি। এর মধ্যে ক্লিনিক বা প্রাইভেট হাসপাতাল ৪৩ টি আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৬৬টি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৫ মাস চলমান থাকলেও সদর উপজেলার ১০৯টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছেন মাত্র ৫টি প্রতিষ্ঠান। এই ৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নবজীবন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সাতক্ষীরা গ্রীন লাইফ হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সাতক্ষীরা সিটি হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সদর উপজেলার বাকি ১০৪ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা চলতি অর্থ বছরে লাইসেন্স নবায়নের জন্য কোন আবেদনই করেননি। যে কারণে এ সমস্ত অবৈধ প্রতিষ্ঠান সময়ে অসময়ে নাম মাত্র তদারকি করা হলেও তদন্ত করা যাচ্ছে না। তবে সদর উপজেলার আওতায় ৫টি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করলেও জেলার বাকি ৬টি উপজেলার ১৪৯টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা চলতি অর্থ বছরে লাইসেন্স নবায়নের জন্য এক জনও আবেদন করেননি। এর মধ্যে দেবহাটা উপজেলায় ৭টি ক্লিনিক ও ৪টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার মোট ১১টি। তালা উপজেলায় ক্লিনিক ৯টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৮টি মোট ১৭টি। শ্যামনগর উপজেলায় ২০টি ক্লিনিক ও ২০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার মোট ৪০টি। আশাশুনি উপজেলায় ক্লিনিক ৭টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৬টি মোট ১৩ টি। কলারোয়া উপজেলায় ক্লিনিক ২০টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১৩টি মোট ৩৩টি এবং কালিগঞ্জ উপজেলা ক্লিনিক ১৬টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১৫টি মোট ৩১টি।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে,প্রতিটি ১০ বেডের একটি ক্লিনিক বা হাসপাতালের জন্য প্রতি ৮ঘন্টা অন্তর অর্থাৎ দিনের ২৪ঘন্টায় ৩জন এমবিবিএস ডাক্তার ও ৬ জন পাশকরা সেবিকা বা নার্স রাখতেই হবে। সাতক্ষীরায় ১০ বেডের কোন হাসপাতালে ৩ জন ডাক্তার ও ৬ জন নার্স কোথাও নাই। এমনকি এক জন ডাক্তার ও এক জন নার্স এক বেলা দায়িত্ব পালন করে কিছু সংখ্যাক ক্লিনিকে। বাকি সব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলে একে বারেই অন কলের ডাক্তার ও নার্স ছাড়াই হাওয়ার উপর। অথচ ৬০থেকে ৭০বেড এর হাসপাতালও আছে এই শহরে। সে সব স্থানে বেড অনুযায়ী যে জনবল থাকার প্রয়োজন তার নূন্যতম ক্যাটাগরি পূরণ না করেই চলছে কোন বাধা বিঘ্ন ছাড়াই। একই সাথে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের জন্য এক জন প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ ও এক জন ডিপ্লোমা প্যাথলজিস্ট রাখতেই হবে। সে বিষয়েও সাতক্ষীরার কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এমন চিকিৎসক পাওয়া যায় না। তিনি জানান,সরকারি হাসপাতালের এক জন প্যাথলজিস্ট বিশেষজ্ঞ এর নাম সব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা ব্যবহার করে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানে সরকারি কোন বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্ট চাকুরি করতে হলে বা তার কাগজপত্র ব্যবহার করতে হলে সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের অনুমতিপত্র থাকতে হবে। সেটাও কারোর নেই।
এ দিকে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের অফিস সহকারী সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন,সাতক্ষীরা শহরে নারিকেলতলা মোড়ে অবস্থিত ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল ইতো পূর্বে ৭০ বেডের অনুমোদন নেওয়া,একই এলাকার সিবি হাসপাতাল ১০০ বেড, সংগ্রাম হাসপাতাল, ৩০ বেড, আনোয়ারা মেমোরিয়াল ক্লিনিক ২০ বেড, ডা.মাহাতাব উদ্দীন হাসপাতাল ১০ বেড ও বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় হাসপাতাল হার্ড ফাউন্ডেশন ক্লিনিকটিও মাত্র ১০বেডের অনুমোদন ইতো পূর্বে নিয়েছিলেন। সাইফুল ইসলাম আরো বলেন,ইতো মধ্যে আমরা হার্ড ফাউন্ডেশন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি,বিশাল বিল্ডিং এবং বেড সহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ বেশি। সে ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৫০ বেডের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করতে বলা হয়েছে কিন্তু তারা তা করেননি। উল্লেখ্য বেড সংখ্যা বেশি চেয়ে আবেদন করলে সরকারের রাজস্বর পরিমান বেশি বলে ক্লিনিক মালিকরা এসব কারচুপি করে থাকে বলে সূত্রগুলোর দাবী। সরেজমিনে দেখা গেছে, ছোট প্রতিষ্ঠান গুলো ১০ বেডের জনবল দেখিয়ে ১০বেডের অনুমোদন নিয়ে পরে সে সমস্ত জনবল আর রাখার প্রয়োজন মনে করে না। শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের তদন্তের সময় সাময়িক ভাবে ভাড়া করা জনবল দেখিয়েই অনুমোদন নেওয়ার পর তারা ভেগে যায়। আর বড় বড় স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান গুলোর জনবলের অবস্থা তো বলার অফেক্ষাই রাখে না। ১০ বা ২০ বেডের জনবল দিয়েই চলছে ৬০-৭০ অথবা ১০০ বেডের হাসপাতাল। ফলে চিকিৎসা প্রদানের নামে রিতিমত জনগনের পকেট কাটা হলেও সেবা প্রদানে যেমনি রয়েছে ব্যর্থতা, তেমনি রয়েছে অনিহাও। এসব অনিয়ম বছরের পর বছর চলে আসলেও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যবস্থা নিতে চরম ব্যর্থ। অপর দিকে পেশি শক্তি ও স্থানীয় শক্তি প্রয়োগ করে ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা এভাবেই সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে হরহমেশাই।
এদিকে, শহরের ভুক্তভোগি একাধিক ব্যক্তিরা জানান, সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের (এমও) মেডিকেল অফিসার ডা.জয়ন্ত সরকার হাতে কালো ব্যাগ নিয়ে এ্যানেস্থাশিয়া প্রদানের নামে এ সমস্ত অবৈধ ক্লিনিকে দিন রাত দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। তবে দায়িত্বশীলদের দাবি এ সমস্ত ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো টিকিয়ে রাখতে তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকেন। কারণ তিনি এই শহরেরই মানুষ। অভিযোগ রয়েছে,শহরের সরদার পাড়ার মোড়ে মঞ্জু মেমোরিয়াল ক্লিনিক নামে তার নিজের একটি ক্লিনিক রয়েছে। সেটিরও কোন সরকারি অনুমোদন নাই। অথচ তিনি সিভিল সার্জনকে সাথে নিয়ে অন্যের ক্লিনিক ভিজিট করে বেড়ান। যেটা বড্ড বেমানান বলে দাবী শহরবাসীর। তবে সিভিল সার্জন অফিসের অফিস সহকারী বলছেন আমরা যতদুর জানি ডা: জয়ন্ত সরকারের ক্লিনিকটি খাতা কলমে বন্ধ আছে। এখন যদি সেটি পরিচালিত হয় তাহলে তা অবৈধ।
অপর দিকে ডা.জয়ন্ত সরকার কর্তৃক ক্লিনিক ভিজিটের বিষয়ে জানতে চাইলে ওই অফিসের আরেক কর্মকর্তা জানান, কোন ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদনের জন্য আবেদন করলে তা যাচাই বাছাই বা অনুমোদন দেওয়া যাবে কি না তা ক্ষতিয়ে দেখতে ৩ সদস্যের কমিটি আছে। কমিটির সভাপতি সিভিল সার্জন মহোদয়,অন্য দুই সদস্য হলেন,সদর উপজেলা টিএইচএ ও একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অথচ হরহমেশাই ডা: জয়ন্ত সরকার যে কোন স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান ভিজিটে যান যা দেখতে বড় অবাক লাগে।
তবে জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চলমান অবস্থা এবং লাইসেন্স নবায়ন নিয়ে রাতে কথা বলেন বাংলাদেশ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাতক্ষীরা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রাসেল। তিনি বলেন,জেলায় ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক এর লাইসেন্স নবায়ন নিয়ে ইতো পূর্বে বেশ জটিলতা ছিল। বিগত সরকার আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় নারকোটিকস এর প্রত্যায়ন নিতে হবে। সে বিষয়ে আমরা কেন্দ্রের সাথে কথা বলেছি। আমরা ওই জাতীয় ওষুধ যদি ব্যবহার না করি তাহলে প্রত্যায়ন কেন নেব। বিষয়টি আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান দপ্তরে কাজ করছেন। একই সাথে পরিবেশের ছাড়পত্র নিয়েও একটা জটিলতা ছিল। ক্লিনিক্যালি ওয়েস্ট ধ্বংস করতে ছয়ঘরিয়ায় আমরা একটি জায়গা নির্ধারণ করেছি। খুব দ্রুতই সেখানে কার্যক্রম শুরু হলে আমরা লাইসেন্সের দিকে এগিয়ে যাবো। অপর দিকে, বিশাল বড় হাসপাতাল অনুমোদন ১০বেড শুনে অনেকটা বিশ্ময় প্রকাশ করে বলেন এমন বিষয় আমার জানা নাই। যদি কেউ করে থাকে অবশ্যই ঠিক করেনি।
এসব বিষয়ে রাতে সেল ফোনে কথা হয় জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডা: আব্দুস সালাম এর সাথে। জেলার ৭ উপজেলার ২৫৮টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে একটিও চলতি অর্থ বছর (২০২৪-২৫) লাইসেন্স নবায়র হয়নি। না হওয়ার কারণ কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,আপনি আমার অফিসে আসেন। বসে কথা বলবো। টেলিফোনে এসব কথা বলা যাবে না।
উপদেষ্টাঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন বার্তা সম্পাদকঃ মনির হোসেন চৌধুরী সম্পাদকীয় কার্য্যালয়ঃ রোড নং- #১০/এ, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০। মোবাইল: ০১৭৮২ ৬৯৮৬২৩ মেইল: dhakarcrimenews@gmail.com, web: www.dailydhakarcrime.com